আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ওষুধের প্রতি আসক্তি এবং অতি-নির্ভরতার ( আচ্ছন্নতা বা ঘুমের ওষুধ )মাধ্যমে মানসিক চাপের চিকিৎসা করে এবং ক্বচিৎ রোগীর নিরাময়ে সক্ষম হয়।গুরু সিয়াগ যোগও (G.S.Y.) নেশা বা মাদকতাকে চিকিৎসার উপায় হিসেবে প্রয়োগ করে, কিন্তু, সে এক আনন্দময় নেশা (দিব্যানন্দ বা পরমসুখ) — গুরু সিয়াগ প্রদত্ত দিব্যমন্ত্রের নিয়মিত জপে যা প্রাপ্ত হওয়া যায়। মুনি-ঋষিরা একে “মাদকদ্রব্যহীন মাদকতা” বলে উল্লেখ করেছেন। দিব্যানন্দ সাধককে কিছুদিনের মধ্যেই যাবতীয় মানসিক চাপ এবং চাপজনিত রোগব্যাধি যেমন– উচ্চ রক্তচাপ, অবসাদ, অনিদ্রা, আতঙ্কগ্রস্ততা ইত্যাদি থেকে মুক্তি দেয়। গুরু সিয়াগ এ বিষয়টিকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :- “সমগ্র পৃথিবীতেই ৮০ শতাংশ রোগের কারণ মানসিক চাপ। কলিযুগ মানবজাতির ওপর তামসিকতার এক চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। গরীব কিংবা ধনী নির্বিশেষে সকলেই ক্রমাগত বিপুল চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান এই মানসিক চাপের চিকিৎসায় অক্ষম। তারা কেবল আচ্ছন্নতার ওষুধ প্রয়োগে স্নায়ুগুলিকে শান্ত করে রাখে। যতক্ষণ ওষুধের ক্রিয়া চালু থাকে ততক্ষণই স্নায়ুগুলি ঘুমিয়ে থাকে ও চাপ ক্ষীণ বলে অনুভূত হয়। একবার ঘুমের ওষুধের প্রভাব কেটে গেলেই মানসিক চাপ এবং তজ্জনিত রোগব্যাধি আবার ফিরে আসে। অবশ্য আমরাও (সিদ্ধ যোগদর্শন) বিশ্বাস করি যে নেশার মাধ্যমেই চাপের চিকিৎসা হওয়া উচিত। কিন্তু, সেই নেশা জড় বা জাগতিক নয়, বরং, আত্মিক হওয়া উচিত। সিদ্ধযোগে ঈশ্বরের নাম জপের ( মন্ত্রজপ) মাধ্যমেই এই মত্ততা জেগে ওঠে।”
“ঈশ্বরের নামজপ এক দিব্যানন্দের জন্ম দেয়। ভগবানের নামোচ্চারণের মাধ্যমে সত্যিই এক পরমানন্দের অনুভূতি লাভ হয়।ভারতের মরমিয়াবাদী ও সাধু-সন্তেরা– যেমন গুরু নানক– এই আনন্দকে ‘নাম খুমারি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। গুরু নানক বলেছেন যে, মাদকদ্রব্যের নেশা রাত পোহালেই কেটে যায়, কিন্তু, নামজপের নেশা কখনওই কাটে না। অপর এক ভারতীয় সাধক কবীরও এই একই কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, নামজপের ফলে প্রাপ্ত আনন্দ দিনদিন বাড়তেই থাকে। আমি যে মন্ত্র দিই তাতে রাধা এবং কৃষ্ণের দিব্যশক্তি মিলিতভাবে থাকে।”
“কৃষ্ণ ছিলেন নবম পূর্ণ অবতার। আরও এক অবতারের আবির্ভাব ঘটবে — কল্কি। আজকাল অনেকেই নিজেদের কল্কি অবতার বলে দাবি করেন, কিন্তু, সমগ্র বিশ্বের দরবারে যিনি সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করবেন তিনিই প্রকৃতপক্ষে কল্কি অবতার অভিধার উপযুক্ত। সুতরাং, ঈশ্বরের নামজপ এক আনন্দময় মত্ততা নিয়ে আসে। ‘ভগবদ্গীতা’য় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একেই ‘আনন্দ’ বলেছেন। গীতায় এ বিষয়ে পাঁচটি শ্লোক আছে : পঞ্চম অধ্যায়ের একবিংশতি ( ২১ সংখ্যক) শ্লোক এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৫, ২১, ২৭, এবং ২৮ সংখ্যক শ্লোক। তিনি এই ‘আনন্দ’কে নানান অভিধায় চিহ্নিত করেছেন – দিব্য বা ঐশ্বরিক আনন্দ যা ইন্দ্রিয়াতীত কিংবা, ভগবানের ধ্যানে লব্ধ আনন্দ। যতক্ষণ না মানব এই ‘আনন্দ’-এর অনুভূতি লাভ করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে ‘সুখ’ ও ‘আনন্দ’কে পৃথক করতে পারে না।”
“যতক্ষণ মানুষের কাছে ধনসম্পদ, দামি গাড়ি, বাড়ি এবং পরিবার পরিজন থাকে, ততক্ষণই সে সুখী। কিন্তু, এর একটিও তার কাছ থেকে সরে গেলে তার সুখ নষ্ট হয়ে যায়। এই জাগতিক সুখই যদি সত্যিকারের সুখ হয় তবে কীভাবে তা এতসহজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে? এই যে ছোট্ট মেয়েটি এখানে বসে আপনমনে খেলছে — আমি কী বলছি তাতে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই — এসব কথায় ও কোনো সুখই পাচ্ছে না। ও শুধু আপনমনে খেলে চলেছে। ওই মেয়েই যখন ২৪-২৫ বছরের হবে তখন অন্য কিছুতে সুখ খুঁজে পাবে। আবার ও যখন আমার মতন ৭০-৮০ বছরের বৃদ্ধা হবে তখন আবার সম্পূর্ণ অন্য কোনো বিষয়ে সুখ লাভ করবে। সুতুরাং, মানুষ যে সুখের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে তা নিতান্তই ইন্দ্রিয়লব্ধ। সেটা প্রকৃত ‘আনন্দ’ নয়।”
“আনন্দ অক্ষয়। তার ‘ক্ষয়’ হয়না। কবীরের কথা অনুযায়ী, ” ভগবানের নামজপের মাদকতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পায় ।” যে মন্ত্র আমি আপনাকে দেব, তার জপ আপনাকে ‘আনন্দ’ দেবে। উপরন্তু, এই ‘আনন্দ’ সমস্তরকম মানসিক চাপ থেকে আপনাকে সম্পূর্ণ মুক্ত দেবে। এই আনন্দ আপনার সঙ্গে অহর্নিশ থাকে এবং কোনোরকম ওষুধ ছাড়াই মানসিক চাপ এবং তজ্জনিত রোগব্যাধি থেকে আপনাকে মুক্তি দেয়। জড় বিজ্ঞানের উপাসক চিকিৎসকদের কাছে এটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে মনে হয়।”
“আমি পাশ্চাত্যে এই পরামর্শ দিয়েছি যে, কেবলমাত্র জড়ের ওপর মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করলে চলবে না জড়ের সঙ্গে সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়াতীতকেও–আত্মাকেও যোগ করতে হবে। জড় এবং ইন্দ্রিয়াতীতে মিলেই সমস্ত রোগব্যাধির বিনাশ ঘটাবে।”