(bn) গুরু সিয়াগ যোগ

হিন্দু ধর্ম কী? (What is Hinduism?)

২০০০ সালে হিন্দুধর্ম বিষয়ে গুরু সিয়াগ প্রদত্ত একটি বক্তৃতার নির্যাস:

“হিন্দু ধর্ম কী? আমাদের কেউ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে আমরা শুধু বলি- আমরা হিন্দু। কিন্তু, এই ‘হিন্দু’ হবার প্রকৃত অর্থ কী — তা আমরা বলতে পারিনা। ‘হিন্দু’ হওয়ার অর্থ এক পূর্ণ বিকশিত  মানব হয়ে ওঠা। আমি জানি যে, এখনও পরিস্থিতি সেই পরিণতিতে পৌঁছায়নি। কিন্তু, যিনি হিন্দু বিশ্বাসকে অনুসরণ করেন, আমাদের ধর্মদর্শন তাঁর কাছে হিন্দুত্বের এই ব্যাখ্যাকেই তুলে ধরে। এই অদ্বৈত দর্শনই সমস্ত জগতের কাছে আমাদের উপহারস্বরূপ। অন্য সব ধর্মই দ্বৈততার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে — যার মূল কথা — ঈশ্বর ও মানব দুই স্বতন্ত্র সত্তা। তারা বলেন, মানুষের পক্ষে সরাসরি ঈশ্বরকে অনুভব করা বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতালাভ অসম্ভব। অন্যদিকে, খুব সুনির্দিষ্টভাবে বললে প্রত্যক্ষ ঈশ্বরোপলব্ধিই হিন্দু দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা ছাড়া মানব জীবন সম্পূর্ণ হতে পারে না।  এখন প্রশ্ন হলো — অদ্বৈত-দর্শন মানবের যে সম্পূর্ণ বিকাশের কথা ব’লে থাকে — তাকে উপলব্ধি করবার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি কী হতে পারে ? একমাত্র হিন্দুধর্মই সেই পথের সন্ধান দেয়। তা একইজন্মে মানবের দু-দুবার জন্ম গ্রহণের কথা বলে। প্রথম — পিতা-মাতার সূত্রে লব্ধ জৈবিক জন্ম।  আবার, যখন সে গুরুর সাক্ষাৎ লাভ করে এবং তাঁর দ্বারা (আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য) দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়, সেটাই  তাঁর দ্বিতীয়, আধ্যাত্মিক জন্ম (গুরু নির্দেশিত পথে আধ্যাত্মিক সাধনাই অদ্বৈতবাদের পথ ধরে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষানুভূতি লাভের প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে)। কোনো ব্যক্তি যখন সিদ্ধযোগের দীক্ষা লাভ করেন এবং আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে চলেন তখন তিনি পরিণামে আত্ম-সাক্ষাৎকার (আত্মোপলব্ধি)  লাভ করেন। সাধক তখন তাঁর প্রকৃত স্বরূপকে অবগত হন (জড়জগতে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে  এতকাল সে যেভাবে দেখে এসেছে তা থেকে একেবারেই ভিন্নভাবে)।”

“আজকাল আত্ম-সাক্ষাৎকারের দর্শন সংক্রান্ত কেতাবী বিদ্যেও আমাদের সকলকে অদ্বৈতবাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতিলাভের জন্য গুরুর আশ্রয় নিতে বলে। যদিও, গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশ করবার আগে-পরের মধ্যে আমাদের মানসিক ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ এবং দৈনন্দিন জীবনাভ্যাসে কোনো লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু, তা বলে এমনটা ভাবা ঠিক নয় যে, একজন্মেই দ্বি-জন্মলাভের এই হিন্দু ধারণা কারোর কল্পনার মিথ্যা উদ্ভাবন মাত্র। ঐ ধারণা একান্তই সত্য (যদি গুরু প্রকৃতই আলোকদ্দীপ্ত চেতনাসম্পন্ন হয়ে থাকেন যিনি শিষ্যের জীবনে আধ্যাত্মিক রূপান্তরণ ঘটাতে সক্ষম)। হিন্দু ধর্ম মানবজাতির জন্য প্রকৃতই এক সার্বজনীন ধর্ম। আমার শিষ্যেরা সব নানা দেশ-ধর্ম-জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায়ভুক্ত।  ভিন্ন ভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা সত্ত্বেও তা‌ঁদের দেহের গঠনগত উপাদান একই। আর তাই পরিবেশগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁদের একইরকম আধ্যাত্মিক রূপান্তরণ ঘটে থাকে । হিন্দুদর্শন ধর্ম পরিবর্তন বা ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাস করে না। বরং, তা শুধুই ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ এক পরিবর্তন এক আধ্যাত্মিক রূপান্তরণের কথা বলে (ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনের  ফলে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করলে ব্যক্তির পরিচিতির যে বাহ্যিক পরিবর্তন হয় — তেমনটা  নয়)। অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের যে মানুষেরা আমার কাছে আসেন, আমি তাঁদের বলি, তোমরা তোমাদের ধর্ম ছেড়োনা, কিন্তু, তোমার অন্তঃশক্তিকে জাগ্রত করবার যে বাস্তব পথ আমি দেখিয়েছি — তাকে অনুসরণ করে চলো এবং তোমার জীবনের রূপান্তরণ ঘটাও।”

error: Content is protected !!