(bn) গুরু সিয়াগ যোগ

পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষা এবং তার ব্যর্থতা থেকেই যাবতীয় ক্রোধের জন্ম। আমরা এই নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাকে এত তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরে থাকি যে যখন তা বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন ঐ নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাশক্তিই আমাদের ভিতর ক্রোধের আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে এবং তা  আমাদেরকেই সবচেয়ে বেশি দগ্ধ করে। গুরু সিয়াগ বলেছেন – “মৃত্যুর পর দেহের সৎকার করা হয়, আগুনে তা ভস্মে পরিণত হয়। কিন্তু, ক্রোধের আগুন জীবিত অবস্থাতেই আমাদের গ্রাস করে নেয়।” ক্রোধের সময় আমাদের বিচারবুদ্ধি সব লোপ পায় এবং তখন আমরা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এমন কিছু করে বা বলে বসি যা আর শুধরে নেওয়া যায় না। কখনও কখনও তাতে অপূরণীয় ক্ষতিও ঘটে যেতে পারে। চরম ক্রোধের ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটে যাবার পরেও  সারাজীবনেও মানুষ তার অভিঘাত ভুলতে পারেনা।

চিকিৎসক এবং থেরাপিস্টরা এই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ উপায়ের কথা বলেছেন। তারা কেউ কেউ ক্রোধের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশের পক্ষপাতী, কেউ ক্রোধকে অবদমন করে সে শক্তিকে গঠনমূলক কাজে ব্যবহারের পরামর্শ দেন, কেউ আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশলে নিজেকে শান্ত করার কথা বলেন। চরমতম ক্ষেত্রে আশু ফললাভের জন্য ডাক্তারেরা ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরামর্শও দিয়ে থাকেন। কিন্তু, এই উপায়গুলি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই কার্যকরী হয়। এগুলি ঐ মুহূর্তের জন্য ক্রোধকে প্রশমিত করে হয়ত কিন্তু, ক্রোধের হাত থেকে তা সম্পূর্ণভাবে মুক্তি দিতে পারে না। অর্থাৎ, এ সবই ব্যক্তিকে ক্রোধের জন্য দায়িত্ব নিতে বলে, তাকে নিজের ভিতরে অবদমনের কথা বলে, কিন্তু,  চিরতরে ক্রোধের বিনাশ ঘটাতে পারে না।

গুরু সিয়াগ বলেন – ” রাগের প্রকাশ বস্তুত অন্তহীন বৃত্তাকার এক গতিভঙ্গি। আপনি আপনার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে অপরকে ভস্মীভূত করতে পারেন; সেও কিন্তু নীরবে আপনার রাগকে হজম করবে না। আপনার আক্রোশের সমানুপাতেই সে তার প্রতিহিংসা প্রকাশ করবে। এর কোথাও কোনো শেষ নেই । এ যেন নিজে নিষ্কলুষ থেকে অন্যকে কলুষিত করবার ইচ্ছা। অথচ, আপনাকে কলুষিত হতেই হবে। রাগ ঘৃণায় পরিণত হয় এবং এই চক্রব্যূহ ভেদ করতে না পারার কারণে মানুষকে আজীবন এই অভিশাপের জের টেনে চলতে হয়।” তাহলে কেমন করে এই চক্র ভাঙা যায়? গুরু সিয়াগ বলেন যে, ধ্যানের সীমাহীন সমুদ্রের অতলে অবগাহন করলেই একমাত্র রাগ লয়প্রাপ্ত হতে পারে। নিজ ক্রোধের দায়িত্ব স্বীকার করার চাইতে অনুশীলনকারীকে বরং নিরপেক্ষভাবে শুধু এটুকুই বুঝে নিতে হবে যে — আদতে ক্রোধ যেহেতু একটি আবেগ, সুতরাং, বাইরের কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির মধ্যে তার কারণ থাকতে পারে না।

লক্ষ করলে দেখবেন, প্রকৃতপক্ষে আপনি কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর ক্রোধান্বিত হন না। আপনি শুধুমাত্র রেগে যান। অর্থাৎ, ক্রোধ বা রাগ একটি বহিঃশক্তি —  আপনি তাকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। আপনার ভিতরে প্রবেশের পরেই কেবলমাত্র তা একটি বিশেষ রূপ লাভ করে —তখনই আপনি কারোর ওপর, কোনো পরিস্থিতির ওপর কিংবা কোনো কাজের ওপর রেগে যান। ধ্যানে এই ক্রোধ গুণহীন বা বিশেষত্বহীন হয়ে যায়। কখনও রাগান্বিত হলে অনুশীলনকারী তা সংযত করবেন এবং ধ্যানে তাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেবেন। যে ক্রোধের শক্তি আপনার দিকে ছুটে এসেছিল, আপনি আবার তাকে বিশ্বপ্রকৃতিতে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। যখন একটি নদী সমুদ্রে পতিত হয় তখন সে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে এবং সমুদ্রের সঙ্গে এক হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ক্রোধকে যখন ধ্যানের সময় প্রকৃতিতে বিসর্জন দেওয়া হয় তখন তা বিশ্বজগতেই লীন হয়ে যায়। সেটি তখন নিজেকে হারিয়ে নিজে ঐ বিশ্বপ্রকৃতিই হয়ে ওঠে। এটা অবশ্যই একবারে সম্ভব হয়না — যখনই অনুশীলনকারীর অন্তরে ক্রোধ জেগে ওঠে তখনই বারেবারে সচেতনভাবে তাকে এই কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। ক্রমে ক্রমে সমস্ত ক্রোধ দ্রবীভূত হয়ে যায় বা মিলিয়ে যায়। রাগ হবার মুহূর্তে যদি আপনার পক্ষে ধ্যান করা সম্ভব না হয়, তবে আপনি সেই মুহূর্তে মন্ত্রজপ শুরু করে দিন। গুরু সিয়াগ বলেন — “ক্রোধের প্রাথমিক তরঙ্গের অনুভূতি লাভ করামাত্র আপনি মন্ত্রজপ চালু করুন। মন্ত্রের তরঙ্গ ক্রোধের নিরর্থকতার বিষয়ে সজাগ করিয়ে তার শক্তিকে আপনার ওপর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আপনাকে অভিভূত করার বদলে ক্রোধের তরঙ্গ তখন তার অভিমুখ পাল্টে ফেলে এবং আপনাকে ছেড়ে চলে যায়।“

error: Content is protected !!