প্রত্যেক ব্যক্তিরই তিনটি সহজাত প্রবণতা থাকে : সাত্ত্বিক (পবিত্র, ভারহীন), রাজসিক (উৎসাহপ্রবণ) এবং তামসিক (নিস্তেজ, জড়)। এই তিন প্রবণতা কেবলমাত্র ব্যক্তির সামগ্রিক মানসিক গঠন, জীবনদৃষ্টি এবং ক্রিয়াকর্মকেই আকার দেয় না, উপরন্তু, তাঁর খাদ্যাভ্যাস কিংবা বিশেষ বিশেষ খাদ্য-পানীয় গ্রহণের প্রবণতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
গুরু সিয়াগ যোগের (G.S.Y.) নিয়মিত অনুশীলন রাজসিক ও তামসিক প্রবণতার ওপরে সাত্ত্বিকতার প্রাধান্যকে সহজতর করে তোলে। ফলে, ঐ শেষোক্ত দুই বৃত্তির বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। সাত্ত্বিক গুণের প্রাধান্য ব্যক্তির অন্তর্নিহিত প্রবণতার রূপান্তর ঘটিয়ে তাঁকে চিন্তায় ও কর্মে আরও বেশি ইতিবাচক, সচেতন, বুদ্ধিমান এবং পবিত্র করে তোলে। এর ফলে, তাঁর খাদ্যাভাস কিংবা পানীয় গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। সামগ্রিকভাবে এই পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথের অন্তরায়গুলি (ব্যক্তির নিজস্ব কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই) নিজে থেকেই তাকে ছেড়ে চলে যায় । অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তির যদি মাদকদ্রব্য, মদ অথবা ধূমপানে আসক্তি থেকে থাকে, তবে তা স্বতস্ফূর্ত ভাবেই তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক — এমন কোনো খাদ্যে যদি অনুশীলনকারীর আসক্তি থাকে, তবে, মন্ত্রজপ ও ধ্যানের ফলে তার অন্তর্নিহিত গুণাবলী ও প্রবণতার পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে তাঁর রুচিরও পরিবর্তন ঘটবে — স্বাস্থ্যহানিকর খাবারের প্রতি অপছন্দ দেখা দেবে এবং সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যের পক্ষে উপযোগী আহার্যের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।
নীচে গুরু সিয়াগ আসক্তি দূরীভূত হওয়ার যৌগিক প্রক্রিয়াকে স্বকীয়ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:–
“মন্ত্রজপের ফলে প্রাপ্ত দিব্য আনন্দ মানসিক চাপ ও মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয়।”
“মাদকাসক্তি থেকেও মুক্তি মেলে। কাউকে কিছুই (মাদকদ্রব্য) ছাড়তে হয় না, বরং ঐ ক্ষতিকর দ্রব্যই ব্যক্তিকে ছড়ে চলে যায় । সুতরাং, কীভাবে একজন নেশামুক্ত হবে? — হবে, কেননা তাঁর আন্তরিক বৃত্তির রূপান্তর ঘটে যায়। ‘মায়া’ নামক বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী শক্তির অন্তর্গত তিন গুণের পারস্পরিক প্রভাবেইএই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই গুণগুলি হলো :- রজস (তীব্র আকাঙ্ক্ষাপ্রবণ ও শক্তিময়), তামস (অন্ধতা, নিস্তেজ, জড়) এবং সত্ত্ব (পবিত্র, আলোকদ্দীপ্ত এবং জ্ঞানসম্পন্ন)।”
“শরীরে যে প্রবণতা প্রবল আপনাকে তার চাহিদা অনুযায়ীই খ্যাদ্যের যোগান দিতে হবে।”
” তামসিক গুণ প্রবল হলে সেটি মাংস , মদ চাইবেই ; কেননা , এইজাতীয় খাদ্যের ওপরেই তামসিকতা বেঁচে থাকে। এই চাহিদা পূরণ করতে না পারলে আপনাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। দীর্ঘ ২০ বছর আফিম সেবনের পর কেউ যদি হঠাৎ তা নেওয়া বন্ধ করে দেয় , তবে ৭ দিনের মধ্যে তার জীবনহানি ঘটবে। কিন্তু , তিনি যদি সিদ্ধযোগের অনুশীলন করে থাকেন তাহলে তিনি নেশামুক্ত হয়ে যাবেন ,তাঁর মৃত্যু ঘটে না , কারণ , ইতিমধ্যেই তাঁর বৃত্তির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সিদ্ধযোগের ক্ষেত্রে এই তামসিক গুণের ওপরেই সর্বপ্রথম প্রভাব পড়ে। তাদের চাহিদার পরিসমাপ্তি ঘটে।”
“এটা একেবারেই চাহিদা আর যোগানের ব্যাপার। একবার স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। জনৈক শ্রোতা তাঁকে বললেন, “স্বামীজি আপনি শুধুশুধুই আপনার সময় নষ্ট করছেন। আমরা কখনওই যোগের উপযুক্ত হয়ে উঠব না। হিন্দু দর্শনের প্রাথমিক বিষয়ই হলো নিরামিষাশী হওয়া। মাংস, মদ ছাড়া আমাদের চলেনা। আমরা কীভাবে যোগ করব?” উত্তরে স্বামীজি বললেন, “আপনাকে কোনো দ্রব্যই ছাড়তে হবে না। দ্রব্যই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।” তার মানে আপনার কোনো বিশেষ কিছু ত্যাগ করবার প্রয়োজন নেই । ঐ জিনিস নিজে থেকেই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।”
“আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আপনাদের মধ্যে যারা মাদকাসক্ত, তাঁরা আজ থেকে ড্রাগ নেবার চেষ্টা করুন । আপনি কিছুতেই পারবেন না, কেননা, আসক্তি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। আপনি চাইলেও আর ড্রাগ নিতে পারবেন না।”
“বাড়মের এর হাজার হাজার মানুষের আফিমের নেশা ছিল; মাদকাসক্তের সংখ্যা এখানেই সর্বাধিক। পাকিস্তান থেকে সীমানা পার করে আফিম এপারে আসে। সেজন্যই বাড়মেরের লোকে আফিম খায়। আমি তাদের বলি, “আফিম ছেড়োনা, কিন্তু, সিদ্ধযোগ করে যাও।” এরপরেও হাজার মানুষ নেশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। তাঁরা বলেন, আফিমে এখন তাঁরা দুর্গন্ধ পান। তাঁরা এটা খেতে পারেন না। এই পরিবর্তনের জন্যই আজকে বাড়মেরের এই লোকেরা এসেছেন।”
“আমি কখনওই বলি না, “ড্রাগ নেওয়া বন্ধ করো।” আমি বলি, “ছেড়োনা।” অনেক গুরুই উপদেশ দেন” এটা ঠিক, ওটা ঠিক নয় “এবং” এটা কোরো না, ওটা করো।” কিন্তু, এসব মানবে কে? লোকে এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। যে কারণে আমি কখনওই কোনো উপদেশ দিই না।”
“আপনাদের এটা জানা দরকার যে, আপনাদের কিছুই ছাড়তে হবে না। অনেকেই তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে — যাঁরা নেশাগ্রস্ত, তাঁদের — এই প্রোগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করেন। তাঁরা বলেন এতে করে এঁরা নেশামুক্ত হয়ে যাবে। মাদকাসক্তরা ভয় পান — পাছে তাঁদের নেশার দ্রব্য ছাড়তে হয়। আমি তাঁদের আশ্বস্ত করি যে, আপনাদের কিচ্ছু ছাড়তে হবে না। এতে তাঁরা খুশি হয়, কেননা, ঘণ্টাখানেক আমার বক্তব্য শুনলেও তাঁদের আর কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।”
“অবশ্য তাঁরা নেশা ত্যাগ করতে ইচ্ছুক না হলেও, কয়েকদিনের মধ্যেই নেশা তাঁদের ছেড়ে চলে যায়। আপনিও নেশামুক্ত হতে পারেন। আপনি নিজেই দেখবেন — ধ্যানের মাধ্যমে কীভাবে এটা ঘটবে। সুতরাং, এভাবেই বৃত্তি পরিবর্তিত হয়ে যায়। একটি বিশেষ বৃত্তি থেকে জন্ম নেওয়া আকাঙ্ক্ষা এভাবেই ছেড়ে চলে যায়। চাহিদা না থাকলে যোগানের আর কোনো প্রশ্নই নেই। শুধুমাত্র চাহিদা থাকলেই যোগান দিতে হবে। বৃত্তি চাহিদা বন্ধ করলেই যোগানও বন্ধ হয়ে যাবে। এর মানে হলো নেশা আর আপনাকে বিরক্ত করবে না। যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা আপনাকে ঐ মাদকদ্রব্য নিতে বাধ্য করছিল সেই আকাঙ্ক্ষাই সম্পূর্ণ চলে গেছে।”