১৯৬৮ সালের শীতকাল ছিল গুরু সিয়াগের জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। তাঁর দৈনন্দিন, গতানুগতিক জীবন আকস্মিকভাবেই এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যখন শারীরিক কোনো ব্যধি না থাকা সত্ত্বেও এক অজ্ঞাত মৃত্যুভয় তাঁকে গ্রাস করেছিল। স্থানীয় এক ভবিষ্যদ্বক্তা গুরুদেবকে বলেন তাঁকে ‘মার্কেস দশা’ ঘিরে ধরেছে। ‘মার্কেস দশা’ — অর্থাৎ, জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী গ্রহ-নক্ষত্রের এমন এক বিচিত্র সমাবেশ যা মৃত্যু ডেকে আনে। স্থানীয় কিছু পুরোহিত তাঁকে বলেন যে, এই অনিবার্য মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় এক বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবী গায়ত্রীর কৃপালাভ করা। কেবলমাত্র গায়ত্রীই — যিনি দিব্য আলোকের দেবী–নিষ্ঠুর মৃত্যুর থাবা থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেন। তাঁকে গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাধ্যমে যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডে পবিত্র হবনক্রিয়া করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। পুরোহিতেরা বলেছিলেন, দেবীর জাগরণ সম্পূর্ণ করতে এবং দৈব সুরক্ষা পেতে তাঁকে ১২৫,০০০ বার মন্ত্রজপ সম্পূর্ণ করতে হবে।
১৯৬৮-র অক্টোবরের নবরাত্রির ( শক্তি দেবীর নয়দিনব্যাপী আরাধনা ) সময় থেকে গুরুদেব এই অনুষ্ঠান আরম্ভ করেন। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি গায়ত্রী মন্ত্রোচ্চারণেরর সঙ্গে সঙ্গে গায়ত্রী মন্ত্রের হবন করতেন। মৃত্যুভয় এতই তীব্র ছিল যে, তিনি পরম আন্তরিকতা এবং মনোসংযোগের সঙ্গে এই দৈনিক অনুষ্ঠান পালন করতে থাকেন। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে তিন মাস সময় লেগেছিল। সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণে গুরুদেব পরে বলেছিলেন যে, তাঁর এতদিনকার জাগতিক জীবনকে পরিবর্তিত করে সে-জীবনকে আধ্যাত্মিকতার পথে পরিচালিত চেয়েই যেন কোনো ঐশ্বরিক শক্তি তাঁকে এই কৃত্রিম ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির দিকে চালিত করেছিল। যে দিন এই অনুষ্ঠান শেষ হলো, সেদিন রাতে গুরুদেব শয়ন করতে গেলেন এই ভেবে যে, যেহেতু এতদিনের শ্রমসাধ্য গায়ত্রী পূজা সমাপ্ত হয়েছে, তাই তিনি পরেরদিন ধীরে-সুস্থে স্বাভাবিক সময়েই উঠবেন। কিন্তু, এতদিনের অভ্যাসের ফলে তিনি পরের দিনও প্রত্যূষেই উঠে পড়লেন। ঘুম ভেঙে চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসতেই তাঁর মনে হলো যে তাঁর শরীরের ভিতরভাগ এক উজ্জ্বল সাদা আলোয় ভরে গেছে। এমনই উজ্জ্বল সে আলো যে তাকে তিনি আর কোনোকিছুর সঙ্গেই এমনকি সূর্যের আলোর সঙ্গেও তুলনা করতে পারলেন না। তিনি লক্ষ করলেন যে ঐ আলোক ভিতর থেকে তাঁর শরীরকে দীপ্ত করে রেখেছে। সে-আলো না উষ্ণ, না শীতল — প্রাণজুড়ানো শান্তির এক আশ্চর্য তরঙ্গ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এমন এক সুখ ও শান্তির প্রবাহে তিনি মগ্ন হলেন — যার সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল না। এই আলো তাঁকে এক অন্তর্দৃষ্টি দিল। গুরুদেব দেখলেন যে, সেই স্বচ্ছ আলোকে তাঁর দেহাভ্যন্তর উজ্জ্বল হলেও তিনি নিজের শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আলাদা করে দেখতে পাচ্ছেন না — তাঁর গোটা শরীরটাই যেন এক ফাঁপা খোলমাত্র।
অতীতে কখনও রেলের হাসপাতালের মর্গে হেল্পার হিসেবে কাজ করার জন্য মানবদেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মাংসপেশী ও হাড়ের অবস্থান তাঁর আগেই জানা ছিল । কিন্তু, সেসবের কিছুই তিনি নিজদেহে দেখতে পেলেন না।
পরক্ষণেই একঝাঁক ভ্রমর-গুঞ্জনের মতো ধ্বনির প্রতি সজাগ হয়ে উঠল তাঁর মন। সেই ধ্বনিতে মনোনিবেশ করামাত্রই তিনি বুঝলেন ,ঐ ধ্বনি তাঁর নাভিদেশ থেকে উঠে আসছে। একটু গভীর মনোসংযোগ করতেই অপার বিস্ময়ে তিনি দেখলেন যে, ঐ ভোমরার গুণগুণ স্বর আসলে অত্যন্ত দ্রুতলয়ে উচ্চারিত গায়ত্রী মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক পরে তিনি বুঝেছিলেন, যে-গায়ত্রীমন্ত্র একদিন স্বেচ্ছাকৃত প্রয়াসে জপেছিলেন তিনি, তা-ই এখন অনিঃশেষ, স্বয়ংক্রিয় হয়ে তাঁকে দিব্যশক্তির সঙ্গে চিরকালের জন্য জুড়ে দিয়েছে। ঐ স্বর্গীয় আলোক আরেকটি বিষয়ে তাঁর চোখ খুলে দিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, জড়জগতে তাঁর বহির্মুখী অস্তিত্ব ও পরিচিতির বাইরে তিনি এক সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা। তিনি তাঁর শরীরী সীমাবদ্ধতা এবং বাহ্যজগতের ব্যক্তিচেতনার সীমায় বদ্ধ নন। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর ব্যক্তিসত্তা এত বিপুল ব্যাপ্তি লাভ করেছে যে, সমগ্র বিশ্বকেই তিনি আলিঙ্গন করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, নিজেকে তাঁর বিশ্বজগৎ বলেই মনে হলো এবং তিনি সে-মুহূর্তে বিশ্বের সজীব- নির্জীব সমস্তকিছুর স্পন্দন উপলব্ধি করতে পারলেন– যেন তারা তাঁর নিজের। ঐ অনন্য অভিজ্ঞতা তাঁকে এও বুঝিয়ে দিল যে, তিনিই প্রকৃতপক্ষে সেই সর্বব্যাপী, অপরিবর্তনশীল, নিরাকার ঐশ্বরিক শক্তি — সুপ্রাচীন বৈদিক দ্রষ্টারা যাঁকে ‘ব্রহ্ম’ বলেছেন।
যখনই গুরুদেব এই অনন্যসাধারণ, বিস্ময়জাগানো অভিজ্ঞতার মুখে আনন্দ, শান্তি ও প্রেমের তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই সেই অসামান্য দৃশ্য যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনই হঠাৎ ভেঙে গেল। বাথরুমের কলের মুখে তোড়ে জল পড়ার কলকল শব্দ তাঁর এই ঘোর লাগা আচ্ছন্নতাকে যেন ভেঙে দিল।
তিনি যখন কয়েকজন শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতকে তাঁর এই অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা বললেন তখন তাঁরা জানাল যে, তিনি সত্যি সত্যিই দেবী গায়ত্রীর আশীর্বাদ ও সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন।